মুখে সশব্দে নিয়ত পড়া প্রসঙ্গ
নিয়তের অর্থঃ নিয়ত আরবী শব্দ। এর বাংলা অর্থঃ ইচ্ছা করা, মনস্ত করা, এরাদা করা, সংকল্প করা। (মুনজিদ, ৮৪৯/ ফতহুল বারী, ১/১৭)]
শব্দটি আমরা বাংলাভাষী লোকেরাও ব্যবহার করে থাকি। যেমন আমরা বলি: আমি এ বছর হজ্জ করার নিয়ত করেছি। অর্থাৎ ইচ্ছা করেছি মনস্থ করেছি।
নিয়তের গুরুত্বঃ শরীয়তে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তির আমল আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হয়না যতক্ষণে বান্দা তার নিয়ত সঠিক না করে নেয়। অর্থাৎ , আল্লাহর জন্যে তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে না করে নেয়। আল্লাহ বলেনঃ (তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ট ভাবে আল্লাহর এবাদত করবে…)। (সূরা বাইয়্যিনাহ/৫(
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আমল সমূহ নিয়তের (ইচ্ছার) উপর নির্ভরশীল, আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি পার্থিব জীবনে সুখ-শান্তি লাভের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে সে তাই পাবে। কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করবে সে তাই পাবে“। (বুখারী, প্রথম হাদীস)
হাদীসটিতে নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বক্তব্য স্পষ্ট যে, মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ হিজরত। হিজরত অর্থ: ইসলামের বিধি-বিধান পূর্ণ রূপে পালন করতে পারা যায়না এমন দেশ ছেড়ে সে দেশে যাওয়া যেখানে বিনা অসুবিধায় পালন করা যায়। অন্য কথায়, কুফরের দেশ ত্যাগ করে ঈমানের দেশে প্রত্যাবর্তন করা। [ফাতহুল বারী, ১/২১] তাই কোন ব্যক্তি যদি এ কারণে দেশ ত্যাগ করে যে, সে যে দেশে যাচ্ছে সেখানে যাওয়ার তার উদ্দেশ্যে হল কোন রমণীকে বিবাহ করা বা দুনিয়াবী কোন সুবিধা অর্জন করা, তাহলে সে তাই পাবে। হিজরতের ফলে কোন নেকী পাবেনা। যদি সে ঈমান বাঁচানোর উদ্দেশ্যে হিজরত করতো, তাহলে নেকী পেত। কাজ একই কিন্তু নিয়তের পরিবর্তনের কারণে নেকী পাওয়া এবং না পওয়া নির্ভর করছে।
প্রকৃত নিয়ত হচ্ছে: ইবনুল কাইয়ুম (রাহেঃ) বলেনঃ “নিয়ত হচ্ছে, কোন কিছু করার ইচ্ছা করা এবং সংকল্প করা। উহার স্থান হচ্ছে অন্তর যবানের সাথে আসলে তার কোন সম্পর্ক নেই। এ কারণে না তো নবীজী হতে আর না কোন সাহাবী হতে নিয়তের শব্দ বর্ণিত হয়েছে”। (ইগাসাতুল্ লাহ্ফান, ১/২১৪(
সত্য প্রিয় ভাই! হ্যাঁ, প্রকৃতপক্ষে নিয়তের স্থান হচ্ছে অন্তর মুখে বলা বা পড়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। উদাহরণ স্বরূপ, ধরুন আপনার গ্রামে মসজিদ উন্নতি কল্পে জালসা হচ্ছে। আপনি জালসায় আগত আলেমদের আলোচনা শোনার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলেন। সাথে এক শত টাকাও নিলেন। সভা শেষে ১০০ টাকা দান করে বাড়ি ফিরলেন। বলুন তো, আপনি যে এ নেকীর কাজটি করলেন এর জন্য কি আপনাকে মুখে আরবী বা বাংলায় এরূপ বলতে হল কি যে, হে আল্লাহ! আমাদের গ্রামে মসজিদের উন্নতি কল্পে আয়োজিত জালসায়, আগত উলামাদের আলোচনা শোনার উদ্দেশ্যে এবং এক শত টাকা দান করার উদ্দেশ্যে জালসা শুনতে উপস্থিত হলাম বা হতে যাচ্ছি ? যদি কেউ এরূপ বলে তাহলে অনেকে তাকে মাথা খারাপ বলে মন্তব্য করবে। নামাযের লাইনে দাঁড়িয়ে আমরা কিন্তু অজান্তে আল্লাহকে আরবীতে তাই বলে যাচ্ছি। বলছিঃ হে আল্লাহ ! অমুকের পিছনে অমুক নামায পড়তে, কিবলামুখী হয়ে উপস্থিত হয়েছি। নামাযী যখন নামাযের উদ্দেশ্যে মসজিদে প্রবেশ করে সেটাই নামাযের নিয়ত হয়। অতঃপর যখন সে যহর, আসর বা মাগরিবের নামায সম্পাদনের জন্য দাঁড়ায় তখন সেটাই তার উক্ত নামাযের নিয়ত হয়। অনুরূপ সুন্নত, নফল, ১, ২, ৩, বা চার রাকাআত পড়ার তার অন্তরে যে ইচ্ছা জাগে সেটাই নিয়ত। মুখে শব্দ দ্বারা কোন কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
আরবী বা বাংলায় বিশেষ শব্দ দ্বারা নিয়ত পড়া: পূর্বের আলোচনা হতে সুস্পষ্ট যে নিয়তের জন্য আরবী বা বাংলায় কিছু বলতে হয় না। তবুও অনেকে আরবীতে এরূপ নিয়ত পড়ে থাকে যেমন ফজর নামাযের নিয়ত কালে বলেঃ ‘নাওয়াইতু আন্ উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা রাকাআতাই সালাতিল ফাজরে ফারযুল্লাহে তাআলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতে- আল্লাহু আকবার’।
নিয়তের বিষয়টির সঠিকতা বিশ্লেষণার্থে সহীহ দলীল ভিত্তিক আরো কিছু আলোচনা করার প্রয়াস করা হলঃ
প্রিয় পাঠক! নামায তথা অযু, রোযা, যাকাত, দান-খয়রাত কোন ক্ষেত্রেই প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরকম শব্দ পড়ে নিয়ত করেন নি। কোন সাহাবী বা তাবেয়ী আর না চার ইমামদের কেউ এরকম নিয়ত পড়তেন। তাই যে আমল নবীজী কিংবা সালাফে সালেহীন দ্বারা প্রমাণিত নয় সে আমল অবশ্যই একটি শরীয়তে আবিষ্কৃত নতুন আমল যা, বিদআত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
“যে ব্যক্তি শরীয়তে নতুন কিছু আবিষ্কার করল যা, শরীয়তের অংশ নয় তা বর্জনীয়’’। (মুসলিম)
নামাযের শুরু ‘তকবীরে তাহরীমা‘ এর পূর্বে নিয়ত পড়া হয়। এখন বিষয়টির সত্যতা যাঁচাই করার জন্য প্রত্যেক নামাযী ভাইকে এতটুকুই অনুরোধ করব যে, নবীজীর নামাযের বর্ণনা প্রত্যেক হাদীসের বইতে বিস্তারিত এসেছে। যদি এধরনের নিয়ত হাদীসে থাকে তো যে কোন হাদীসের বই পড়ে দেখতে পারেন। অবশ্যই কোথাও পাবেন না।
নিম্নে নামায শুরু করার সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করা হচ্ছে যা দ্বারা বুঝা যেতে পারে যে, আল্লাহু আকবার বলার পূর্বে মুখে নিয়ত পড়ার প্রমাণ আছে না নেই।
# ইবনে উমার (রা:) বলেনঃ নবীজী যখন নামাযে দাঁড়াতেন; তখন তিনি তাঁর হাত দুটি বাহু বরাবর উঠাতেন। অতঃপর তকবীর ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন।) মুসলিম, অধ্যায়ঃ নামায, অনুচ্ছেদ নং ৯ হাদীস নং ৮৬০-৮৬১(
হাদীসটি স্পষ্ট যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তকবীরের মাধ্যমে নামায শুরু করতেন। নিয়ত পড়ে তকবীর দিতেন না।
# নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায ভুলকারী জনৈক সাহাবীকে নামায শিক্ষা দেওয়ার সময় বলেনঃ ‘‘যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন তকবীর দিবে’’। )বুখারী, নং৭৯৩(
এখানেও হাদীস স্পষ্ট যে, নামাযে দাঁড়ালে তকবীর দিয়ে নামায শুরু করতে হয়। কেউ যদি নিয়ত পড়ে শুরু করে তাহলে হাদীসের বরখেলাফ তো অবশ্যই হয়।
# নবীজী আরো বলেনঃ ‘‘নামাযের চাবি পবিত্রতা অর্জন, (পার্থিব কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা ইত্যাদি) তকবীর বলার মাধ্যমে হারাম হয়, (আর সে সকল হালাল হয়) সালামের মাধ্যমে’’। (তিরমিযী, অধ্যায় পবিত্রতা অর্জন, প্রথম হাদীস)
এ হাদীসে নামাযের শুরু এবং শেষ বর্ণিত হয়েছে। শুরু হচ্ছে তকবীরে তাহরীমা তথা আল্লাহু আকবার বলা। নিয়ত পড়া নয়।
উল্লেখ্য যে, কায়েদা বগদাদীতে নিয়ত লেখা আছে বলে কিছু অজ্ঞ লোক তাই দলীল মনে করে এবং আমল করে। এটি চরম ভুল। কায়েদা বগদাদী শরীয়তের কোন দলীলের বই নয়, উহা কেবল একটি আরবী বর্ণ পরিচয়ের বই। যেমন বাংলা বর্ণ পরিচয়ের জন্য শিশু শিক্ষা, বাল্য পাঠ বা অন্য কোন বই। শরীয়তের দলীল হচ্ছে কুরআন এবং হাদীস।
মুখে উচ্চারণকৃত নিয়তের ক্ষতিকারক দিক সমূহঃ
· ১- অনেক ভাইকে নামাযের কথা বললে, বলেঃ নিয়তই জানিনা নামায কিরূপে পড়ব? অর্থাৎ সে মনে করে আরবীতে তৈরি করা এসব নিয়ত মুখস্ত না করলে নামায হয় না। কি আশ্চার্য ! আবিষ্কৃত বিদআতী কিছু শব্দ মানুষকে নামায থেকে দুরে সরায় !
· ২- মকতব মাদরাসায় অনেক ছাত্রকে ডজনেরও অধিক আরবী নিয়ত মুখস্ত করানো হয়, অথচ দেখা যায় সে ছাত্রটি এখনও দু চারটি সূরা মুখস্ত করে নি। বলুন তো, এ ক্ষেত্রে নিয়ত মুখস্ত করানো জরূরী না সূরা মুখস্ত করানো জরূরী?
· ৩- যেহেতু নিয়তের প্রচলিত বাক্যগুলি আরবী ভাষায় আর আমরা আরবী বুঝি না। অন্যদিকে নামাযের রাকাআত সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন, অনুরূপ নামাযও বিভিন্ন। যেমন ফরয, সুন্নত এবং নফল। আর নিয়তে বর্ণিত থাকে এই সব ব্যাপার। তাই নিয়তের শব্দ সমূহে সামান্য পার্থক্য থাকে। এবার মুখস্ত করার সময় এবং নামাযের পূর্বে পড়ার সময় অনেকের গোলমাল বেঁধে যায়, ফলে এই সমস্যায় পড়ে কেউ মাদরাসার পড়া ছাড়ে আর অনেকে রাকাআত ছড়ে। অর্থাৎঃ নামাযী মসজিদে ঢুকে দেখে যে, ইমাম সাহেব সূরা ফাতেহা পড়ার পর অন্য ছোট সূরা পড়তে শুরু করেছে, তখন সে তাড়াতাড়ি নিয়ত পড়তে গিয়ে গোলমালে পড়ে। দেখা যায় ইমাম সাহেব রুকূতে চলে গেছেন আর সে হাত খাড়া করে নিয়তের গোলমাল ঠিক করতে ব্যস্ত। আর অনেক সময় নিয়ত পড়তে গিয়ে সূরা ফাতেহা না পড়ে রুকূতে শামিল হয়। সূরা ফাতেহা যা পড়ার শক্ত নির্দেশ এসেছে সে তা পড়তে অনিচ্ছুক কিন্তু তৈরিকৃত নিয়ত পড়তে এ অবুঝ খুবই সচেতন!খুবই আগ্রহী!!
লেখক: আব্দুর রাকীব (মাদানী)
দাওয়াহ সেন্টার, আল্ খাফজী, সৌদী আরব।
আব্দুল আলীম
7 Mar 2012জাযাকাল্লাহু খাইরান।
mumin
8 Mar 2012Assalamu Alaikum,
Brother, Did you forget to post this article in PDF format? Please post in PDF format of all your documents.
Zajakumullahu Khairan
mumin
8 Mar 2012Assalamu Alaikum,
Dear brother,
Thanks a lot that I have found the PDF format option of this document. Perhaps earlier it was a problem with my PC.
Zajakumullahu Khairan,
মো: রাশিদুল হাসান খাঁন
8 Mar 2012আসসালামু আলাইকুম। আপনার সালাত বিষয়ে সুন্দর পোষ্ট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমিও মনে যে সকল জায়গায় ইমাম সাহেব নীরবে পড়বেন সেখানে আমাকেও নীরবে পড়তে হবে। আর ইমাম অন্য সূরা পড়লেও আমাকে সূরা ফাতেহা পড়তে হবে যদি আমি সূরা ফাতেহা পড়ার সময় আমি শরীক না হয়ে থাকি। খোদা হাফেজ।
zia
10 Oct 2012আসসালামু আলাইকুম। আপনার সালাত বিষয়ে সুন্দর পোষ্ট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমি জানতে চাই যে সকল জায়গায় ইমাম সাহেব নীরবে সুরা পড়বেন সেখানে আমাকেও কি নীরবে পড়তে হবে?
আর রমজানের নিয়তের ব্যাপারটা জানতে চাই কারন শুনে এসেছি সেহেরীর পড়ে নিয়ত না করলে রোজা হয় না!৩০রোজার ৩০ফরজ৩০নিয়তের ৩০ফরজ মোট ৬০ফরজ!আল্লাহ্ আপনাকে ভাল রাখুন!
সাকিব খান
16 Nov 2012কি ব্যাপার লেখক আমরা জিজ্ঞাসাবাদীদের উত্তর দেয় না কেন ?